“অন্ধজনে দেহ আলো”
কলকাতার বাতাসে নানান রোগজীবাণু ভেসে বেড়ায়, এতে নতুন কিছু নেই। শীতের টান পড়েছে চামড়ায়, ফাটাফুটি দিয়ে তেমনই কোনো জীবাণুবাবাজি ঢুকে পড়েছিল ডান আঁখিপল্লবে।রকি বালবোয়ার ম্যাচের পরের মতো চোখ নিয়ে গৃহবন্দী থাকতে হয়েছিলো সপ্তাহখানেক। বড় ডাক্তারবাবুকে দেখাবো বলে একদিন গেছি বাড়ির কাছেই ড. নীহার মুন্সী আই ফাউন্ডেশনে। ওয়েটিং হলে আমার পাশে এসে বসলেন এক বছর পঁয়ত্রিশের ভদ্রসন্তান। তখন খেয়াল করিনি, ডানদিকে “অপাঙ্গে দেখা”র প্রশ্নই নেই, কিন্তু কথোপকথন শুনে বুঝলাম আমাদের পেছনের সারিতেই ওনার বাবা এবং স্ত্রী বসেছেন। বৃদ্ধের ছানির অস্ত্রোপচার হয়েছে দিনকয়েক আগে, ফলো আপের জন্য বৌমা গাড়ি চালিয়ে নিয়ে এসেছেন ক্লিনিকে।
“এখানে আসার অন্য কোনও রাস্তা নেই, বাবা? এই বস্তির রাস্তাটা যা ডেঞ্জারাস।”আমার পাশের ভদ্রলোকটিকেও শুনলাম সায় দিচ্ছেন। বৃদ্ধ বললেন,”আছে, তিন-চার ভাবে আসা যায়, কিন্তু অনেক গলিটলি, আমি তো দেখতে পারছি না, বলে দিতে পারতাম না।”
“আরে অপারেশনের দিনেও দেখলাম, আজকেও এক মহিলা হঠাৎ করে গাড়ির সামনে এসে পড়লো। এদের কোনো সেন্স নেই! আমি সাবধানেই চালাচ্ছিলাম, জোরে ব্রেক দিতে হলো শুধুমুধু”।
“সব তো খোট্টা! জবরদখল করে বসেছে এখানে রাস্তার ধারে, দেখনি? যেখানে যাবে মেস্ করে রেখে দেবে। এদের আবার সেন্স! কিন্তু গাড়ি যদি কোনো কারণে একটু টাচও হয়ে যায়, তাহলে তোমাকে কিন্তু শেষ করে দেবে! তাই আমাদেরকেই সাবধানে চলাতে হয়”, আমার পাশের জন যোগ করেন।
“সত্যি! ভোটের জন্য রেখে দিয়েছে এই বস্তিগুলো। ন্যুইস্যান্স ভ্যালু সব।” ভদ্রমহিলার দেখলাম তখনো রাগ কমেনি।
“তোমরা যেটাকে বস্তি বলছো, ওগুলো ম্যুনিসিপ্যালটির কোয়ার্টার্স আসলে।” এবারে বৃদ্ধের গলা শুনতে পাই।
“ঐ একতলা ঝুপড়ির মতো বাড়িগুলো কোয়ার্টার্স?”
“হ্যাঁ। ম্যুনিসিপ্যালটির সুইপারদের। ঐ যে সকালে বাঁশি বাজিয়ে আসে না আবর্জনা নিতে? তারপর রাস্তা ঝাঁট দেওয়া, বাথরুম পরিষ্কার-টরিষ্কার সব ওরাই করে। বাঙালিরা তো আর করবে না এসব কাজ।”তরুণ দম্পতিটিকে চুপ করে যেতে দেখলাম।
Refraction test -এর জন্য ততক্ষণে আমার ডাক এসেছে, ওদের ছেড়ে উঠে গেলাম ভেতরের ছোটো ওয়েটিং হলে। ভেতরের সমস্ত চেয়ার ভর্তি। অগত্যা স্বাস্থ্য বীমা সহায়কের কেবিনের দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়ালাম। এই ভদ্রমহিলা, দীপাদিকে আগেও দেখেছি অসীম ধৈর্য্য নিয়ে বয়স্ক মানুষগুলোর সঙ্গে কথা বলতে, বীমা কোম্পানির ক্লেইম ফর্ম ভরে দিতে। আজ বছর পঁয়ষট্টির এক মহিলা বসে ওনার সামনে। ছানির অপারেশন হবে। পরের সপ্তাহে তারিখ দেওয়া হয়েছে।
দীপাদি বার দুয়েক ফাইল উল্টেপাল্টে দেখে মুখ কাঁচুমাচু করে বললেন, “বি এস এন এলের হেল্থ প্ল্যানটা তো বন্ধ করে দিয়েছে। আপনাকে কিন্তু ক্যাশে পেমেন্ট করতে হবে।”
“জানি ভাই। যারা এখনো চাকরিতে আছে, তাঁরাই বেতন পাচ্ছেনা, আমাদের চিকিৎসার টাকা আর কোত্থেকে দেবে বলো?”
ঠিক সে সময়েই অপ্টোমেট্রিস্ট এক ভদ্রলোক কেবিন থেকে বেরোতে গিয়েই আমার মুখোমুখি।
“ওহ্ আপনার swellingটা এখনো কমেনি দেখছি! একটু দাঁড়ান। আসছি।”
শুনেছি দৃষ্টির জোর কমে গেলে নাকি অন্যান্য ইন্দ্রিয় বেশি সজাগ হয়ে ওঠে। দীপাদি শুনলাম বলছেন, “আপনার টোটাল খরচা হবে ১৬৫৮১ টাকা। অপারেশনের দিন সকালে পুরোটা নিয়ে আসবেন।”