জঙ্গল সরে গেলেও অবচেতনে রেখে যায় স্থায়ী ছাপ। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে নরম গদিতে শুয়েও হঠাৎ কোনো উঁচু জায়গা থেকে পড়ে যাওয়ার দু:স্বপ্ন এক ধাক্কায় জাগিয়ে দিলে জানবেন অগণিত প্রজন্ম আগে আপনার কোনো পূর্বপুরুষ জঙ্গলের গাছের ডালে শুয়ে রাত কাটিয়েছেন, ভয়ে ভয়ে থেকেছেন ঘুমের মধ্যে টুপ করে খসে পড়লেই এক্সেরেটডনের হামলে পরার।
গুহামানবেরা সব কিছুই শিখতেন পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে। ক্ষতস্থান থেকে রক্ত ঝরলে তার গন্ধে গন্ধে উপস্থিত হতে পারে হিংস্র শ্বাপদ, এটা বুঝতে তাদের বেশি সময় লাগার কথা নয়। তাহলে ঋতুস্রাব শুরু হওয়া নারীদের এই আক্রমণ থেকে বাঁচানোর উপায় কী? জানা যায় না। কিছুটা অনুমান করা যায় আদিম গুহাচিত্রের থেকে। না, ভারতবর্ষের কোনো গুহাচিত্রে এমন ছবি নেই, কিন্তু বর্তমান কালযাপনের ছবিই এখানে এতো জীবন্ত, যে সেরকম ঐতিহাসিক প্রমাণের প্রয়োজন পরে না।
প্রাগজ্যোতিষপুর। পুরো শহরটাই নাকি আজকের গৌহাটির তলায় চাপা পড়েছে। তবে ওই যে অতীতের পশ্চাদপসারী পায়ের ছাপ। আজও গৌহাটি মন্দিরের শহর। এদের মধ্যে অন্যতম নবগ্রহ মন্দির প্রাচীন জ্যোতিষশাস্ত্র চর্চার সাক্ষ্য বহন করে। কিন্তু ফি বছর অম্বুবাচীর সময় এবং অন্যান্য দিনেও গৌহাটির আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু কামাখ্যা। শক্তিপীঠগুলোর মধ্যে অগ্রগণ্য কামাখ্যাতে দেবীর যোনি পড়েছিল বলে বিশ্বাস। সাধারণ মানবী নন, স্বয়ং শক্তিস্বরূপিণী, তাই তাঁর ‘মাসিক’ হয়না, অম্বুবাচীর দিনগুলো বার্ষিক ঋতুস্রাবের। বর্ষাঋতু। শক্তি এখানে তাই সজলা, প্রাণদায়িনী। মন্দিরের আশেপাশে যদিও এখন মাতা বৈষ্ণোদেবী আদলের দেবীমূর্তি কামাখ্যার প্রতিরূপের নামে বিক্রিবাট্টা হয়, আসলে এখানে উপাস্য যোনীর আকারের এক কুন্ড, অম্বুবাচীর সময় যার জল হয়ে ওঠে রক্তাভ। আপামর ভক্তসাধারণকে তো আর দেবীর এই অবস্থা দেখতে দেওয়া যায় না। তাই চারদিনের জন্য মন্দির বন্ধ করে দেওয়ার রীতি। সব মিটে গেলে স্থানীয় প্রভাবশালীরা এখনো প্রচুর অর্থ ব্যয় করেন দেবীরক্তে রঞ্জিত একটুকরো কাপড়ের জন্য।
আর যদি কোনো বছর দেবী পিরিয়ড মিস করেন? হিপ্পোক্রেটসের মতে এক বালতি পরিমাণ রক্ত না ঝরলে বুঝতে হবে ‘শরীর খারাপ’ হয়েছে। জনশ্রুতি বলে শেষ এরকমটা হয়েছিল ১৯৫০-এ। যে আজ্ঞে, আসামের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ভূমিকম্পের বছর ছিল সেটা। কোচ রাজাদের সঙ্গে কামরূপের যোগাযোগ বহু প্রাচীন। এমনকি এখন যে মন্দির আমরা দেখি তাও তাঁদের পুনর্নির্মিত। অথচ এদের উত্তরসূরীরা আজও অন্য ভক্তদের সঙ্গে যোগ দেন না অম্বুবাচী পালনে। কারণ হিসেবে বলা হয় সেই একই অভিশাপের কথা। কোচ রাজা নরনারায়ণ ও তাঁর ভাই এবং সেনাপতি চিলাৰায় নাকি নৃত্যরত অবস্থায় রজ:শীলা ষোড়শী দেবীকে দেখে ফেলেছিলেন। ফলে দেবীরোষে পড়ে নরনারায়ণই হলেন কামরূপের শেষ কোচ রাজা, তাঁর বংশধরদের সরে যেতে হয়েছিল কোচবিহারে।
কিন্তু নৃত্যরতা দেবী? আশ্চর্যজনকভাবে অস্ট্রেলিয়ার আপার ইউল নদী উপত্যকায় পাওয়া গুহাচিত্রে দেখা যায় অস্ত্র হাতে নিয়ে নাচতে থাকা এমনই দুই নারীকে। তাহলে কী “শরীর খারাপ”-এর সময় মেয়েদের সব রকম শারীরিক কসরতই ছিল স্বাভাবিক, এমনকি ষোড়শ শতকের কামরূপে? আবারো উত্তর মেলে না।
কামাখ্যার পুরোহিত সম্প্রদায় অবশ্য আপনাকে বলবেন কামরূপে দেবী এইভাবে পূজিতা বলেই ঋতুস্রাব নিয়ে এখানকার সমাজে তেমন বিধিনিষেধ নেই। যেটা আছে সেটা হলো উৎসবমুখরতা। টুলুনি বিয়া বা ছোট বিয়ে। প্রথম মাসিক শুরু হওয়ার কিছুদিন পরে মেয়েটির নারীত্ব প্রাপ্তির উৎসব এটি। কিন্তু প্রথম সে দিনটি কেমন?
আমার কন্যা গৌহাটির স্কুলে দু’বছর পড়ার সময় ওর বন্ধু সংখ্যা দু’আঙুলে গুনে ফেলা যেত। তাদের মধ্যে প্রথম এবং অন্যতম একটি দুষ্টু মিষ্টি মেয়ে, যার নাম ধরে নিন অনাম্নী। সম্ভ্রান্ত, উচ্চশিক্ষিত পরিবার। বাবা স্ট্রাকচারাল কন্সাল্ট্যান্ট। ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় বাড়িঘর, ইমারত, উত্তাল ব্রহ্মপুত্রের উপর দাঁড়িয়ে থাকা সেতু ইত্যাদি সুরক্ষিত আছে বা থাকবে কিনা সেসব জটিল গণনার কাজে ওর বিশেষ নামডাক। আমার সম্ভাব্য বদলির খবর পেয়ে ওরা একদিন ওদের বাড়িতে নৈশভোজের আমন্ত্রণ করে বসলেন। বিশালকায় লিভিংরুমের সর্বত্র সুন্দর রুচির ছাপ। কিন্তু গুনগুনের প্রিয় বন্ধুটির দেখা নেই। ওর মা জানালেন মেয়ের প্রথম মাসিক শুরু হয়েছে। তাই ওকে একটা ঘরে বন্ধ থাকতে হবে পাঁচদিন। আরো বেশিও হতে পারতো, কিন্তু জ্যোতিষী ওর নক্ষত্রবিচার করে পাঁচদিনেরই বিধান দিয়েছেন। কাউকে কাউকে তো বারোদিন পর্যন্ত থাকতে হয়। চারদিনের মাথায় ওকে স্নান করানো যাবে। এ সময় সূর্য, চন্দ্র, গোমাতা এবং কোনো পুরুষমানুষ, এমনকি ওর বাবার মুখদর্শন করাও যাবে না। গুনগুন চাইলে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বলতে পারে। তো সে কথাটথা সেরে বাড়ি ফেরার পথে উত্তেজিত হয়ে বলেই ফেললো, “জানো মাম্মা, অনাম্নীকে একটা স্ট্র বেডে শুতে হচ্ছে আর শুধু কলা খেতে হচ্ছে!” উপরি পাওনা অবশ্য এই যে স্কুলে যেতে হচ্ছে না, আর পাঁচদিন কামাই হলেও প্রিন্সিপাল পাঁচনগেলা মুখ করে জবাবদিহি চাইবেন না, কারণ আজকের প্রাগজ্যোতিষপুরেও জ্যোতিষীদের নিদান অমোঘ সত্য যে!
জঙ্গলের আইন নিয়ে কী যেন লিখেছিলাম আগের কিস্তিতে?