বাবার থেকে বয়সে অনেকটাই ছোট। ন’কাকা না বলে আমরা ডাকতাম বড়আপ্পা, কেন জানি না।
১৯৮২ বা ‘৮৩। আমি কিন্ডারগার্টেনে ভর্তি হইনি তখনো। দাদা ক্লাস টু’র বার্ষিক পরীক্ষা দিয়েছে। থাকা হয় ধনদেবী খান্না রোডের ভাড়াবাড়িতে। সে বছর বড়আপ্পা স্কুলের শীতের ছুটিতে কলকাতায় এলো টেপ ডেক নিয়ে। শিলিগুড়ির হংকং মার্কেট থেকে কেনা নতুন নতুন জিনিস ভীষণ শৌখিন বেহিসেবী খরুচে লোকটার হাত ধরে ঢুকে পড়তো আমাদের শৈশবে। মনে আছে ওদের বিয়ের ঠিক আগে আগে একরকম জোর করেই একটা ইনডোর ক্রিকেট বোর্ড কিনিয়েছিলাম। যাই হোক সেই বিরাশি বা তিরাশির এক দুপুরে, বাবা চলে গেছে অফিসে, উচ্চকিত “I am a disco dancer” পাশের ঘর থেকে ভেসে আসছে শুনে ছুট্টে গিয়ে দেখি আমার থেকে বছর কুড়ির বড় বড়আপ্পা আর চার বছরের বড় দাদা ছোট খাটটার উপর উঠে গানের সঙ্গে উদ্দাম নাচছে। তারপর ধড়াম। খাট ভেঙ্গে দু’জনেই মাটিতে।
তা এরকম দুর্ঘটনা সেই শেষ নয়। আরেকটু বড় হয়েছি। সেবারেও পুজোয় ভীষণ বৃষ্টি হয়েছে। প্রতিবারের মতো আমরা দিনহাটায়। দোলনদা, বুবাইদা, দাদা আর আমি এক সাইকেল রিক্সায় উঠেছি। আমি যথারীতি কোলে। রিক্সা চালাবে কে? না, বড়আপ্পা। সাইকেল রিক্সা খুব বিপজ্জনক যান। তিনচাকার অন্য কোন বাহনই এতটা ভারসাম্যহীন হয় না। বেগতিক বুঝে ঠিক সময়মতো উল্টোদিকে রাস্তায় দিলাম ঝাঁপ। চালক ও বাকি সওয়ারিরা ততক্ষণে রিক্সা সহ পাশের কাদা ভর্তি হাইড্রেনে গিয়ে পড়েছে। ‘নায়ক’ ছবির অনিল কাপুরকে মনে আছে? সেরকমই আপাদমস্তক কাদামাটি মেখে চারমূর্তি উঠে এলো।
১৯৯১-এ মহারাষ্ট্রে বেড়াতে গেছি। সদাশিব হনুমন্তরাও জেসুদেবন বিরাজদারের সাদা অ্যাম্বাসাডর আমাদের সফরসঙ্গী হলো ঔরঙ্গাবাদ থেকে। মহাবালেশ্বরের পথে সহ্যাদ্রীর ঘাটিতেও দেখা গেল সদাশিব সমতলের গতিই ধরে রেখেছেন। সামনের সীটে বসে প্রত্যেক মোড়ে বড়আপ্পাকে ইষ্টমন্ত্র জপ করতে দেখে সদাশিব জিজ্ঞেস করলেন কাকে স্মরণ করছে? সেটা ছিল বড়আপ্পার ব্যাচেলর ট্রিপ। পরের জানুয়ারিতেই বিয়ে। সেটাও সম্ভব হচ্ছে বাবা মায়ের হস্তক্ষেপে। রীতিমত পুরোহিত দর্পণ ঘেঁটে বাবা একটা রত্নসম শ্লোক তুলে এনেছিলো যাতে এই অসবর্ণ বিয়েটা আটকানো না যায়। বড়আপ্পা আর আপ্পির জাতধর্ম আসলে একটাই। খেলোয়াড়ের। দু’জনে জুটি বেঁধে টেবিল টেনিসে জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হয়েছে আগেই। বিয়ের পর দেখলাম বাড়িতে একমাত্র বড়আপ্পিই আমাকে দাবায় হারিয়ে দিচ্ছে বারবার।
রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস রোগটা সেই উজ্জ্বল বড়আপ্পিকে আস্তে আস্তে পরনির্ভরশীল করে তুললো। যেভাবে নিজেদের সামলেছে দু’জনে দুজনকে ঐ প্রতিকূলতায়, তাতে ভালোবাসা বললেই আমার ওদের কথাই মনে পড়ে। তারপর রাজগঞ্জের বাড়ির সামনের মাঠে বড়আপ্পা শুরু করলো নিজের ফুটবল আকাদেমি। মফস্বলের অতি দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা ছেলেগুলো স্বপ্ন দেখতে শিখছিলো। তখন ইস্টবেঙ্গলের জুনিয়র টিমের কোচের দায়িত্বে বড়আপ্পা। কাঞ্চনজঙ্ঘা স্টেডিয়ামে দলের ম্যাচ চলাকালীন পড়ে গেল। কিছুদিন পরেও হাঁটাচলায় অসুবিধে থাকায় উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজে চিকিৎসা শুরু হয়। মাস কয়েক পরে ওখানকার চিকিৎসক দিল্লির AIIMS-এ নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের কার্যালয়ের সুপারিশে ওরা অগ্রাধিকার দিয়ে পরীক্ষা করে জানালেন মোটর নিউরন ডিজিজ। কিছুদিন পরে হুইলচেয়ার। ওদিকে আকাদেমির ছাত্ররা ডার্বির জয় উৎসর্গ করছে উত্তম স্যারের নামে, এই খবরগুলোতে অভ্যস্ত হয়ে উঠছিলাম আমরা। আজ প্রায় দু’বছর পর এক অসহনীয় উল্টোগুনতি শেষ করে চলে গেল মানুষটা। আত্মীয়বিয়োগ নয়, বন্ধুবিয়োগের ভার আজ।
(ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের পক্ষ থেকে ২০১৮তে উত্তম চক্রবর্তীর হাতে তুলে দেওয়া হয় জীবন কৃতি সম্মান। ময়দানে মোহনবাগান বা ইস্টবেঙ্গল মাঠে ওঁর হাত ধরেই গেছি। সেই পালা সাঙ্গ হলো আজ।)